দেশের সোয়া পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষের দুটি করে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) রয়েছে। একাধিক এনআইডি করতে অনেকে বাঁ ও ডান হাতের ছাড়াও পায়ের আঙুলের ছাপও ব্যবহার করেছেন। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কর্মকর্তারা বলেছেন, একাধিক এনআইডি নেওয়া সম্ভব হয়েছে কিছু অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে। বিষয়টির নিশ্চিত করেছেন ইসির সচিব শফিউল আজিম।ইসি সূত্র জানায়, বর্তমানে ইসির তথ্যভান্ডারে (ডেটাবেইস) ৫ লাখ ৩০ হাজার ২৫৮ জন দ্বৈত ভোটার রয়েছেন। অর্থাৎ তারা প্রত্যেকে দুটি করে এনআইডি নিয়েছেন। অথচ জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, একজন নাগরিক একটি এনআইডি পাবেন। আইন লঙ্ঘনে দণ্ডও আছে। তারপরও একাধিক এনআইডি নিয়েছেন সোয়া পাঁচ লাখের বেশি মানুষ। যাদের মধ্যে ডা. সাবরিনা শারমিন ওরফে সাবরিনা আরিফ চৌধুরী, সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদের দুই ভাই হারিছ আহমেদ ও তোফায়েল আহমেদ ওরফে জোসেফ রয়েছেন। এনআইডি জালিয়াতির অভিযোগে ডা. সাবরিনার বিরুদ্ধে মামলা করেছে ইসি। আরও অনেকের বিরুদ্ধে এমন মামলা করা হয়েছে। হারিছ ও জোসেফের নামে করা চারটি এনআইডি বাতিল করেছে ইসি। আরও অনেক এনআইডির বিরুদ্ধে এমন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, কেউ জ্ঞাতসারে একাধিক এনআইডি নিলে এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। অর্থাৎ ইসির তথ্যভান্ডারের ৫ লাখ ৩০ হাজার ২৫৮ জন দ্বৈত ভোটার আইন অনুযায়ী অপরাধী। কারণ, তাদের একাধিক এনআইডি রয়েছে। আইনে আরও বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি এনআইডি জাল করলে বা এমন এনআইডি বহন করলে অনূর্ধ্ব ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এনআইডি জাল করতে সহায়তাকারী এবং জাল এনআইডি বহনে প্ররোচনা দেওয়া ব্যক্তি অনূর্ধ্ব ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং অনধিক ১ লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।ইসি সূত্র জানায়, ভোটার হতে শুরুতে দুই হাতের বৃদ্ধাঙুল ও তর্জনীর ছাপ নেওয়া হতো। পরবর্তী সময়ে দুই হাতের ১০ আঙুলের ছাপ ও চোখের আইরিশের প্রতিচ্ছবি নেওয়া শুরু করে ইসি। ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় ছাড়া সারা বছর থানা ও উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে নতুন ভোটার নিবন্ধনকালে এসব ছাপ ও প্রতিচ্ছবি নেওয়া হয়। কেউ নতুন ভোটার হতে গেলে তার আঙুলের ছাপ ও আইরিশের প্রতিচ্ছবি ইসির তথ্যভান্ডারে থাকা প্রায় ১৩ কোটি নাগরিকের আঙুলের ছাপ ও আইরিশের প্রতিচ্ছবির সঙ্গে মেলানো হয়। সেখানে কারও সঙ্গে না মিললে আগ্রহী ব্যক্তিকে ভোটার করা হয়। ভোটার হিসেবে নিবন্ধন সম্পন্ন হলে তিনি একটি এনআইডি পান। ২০১৯ সালের আগে কেউ ভোটার হতে আবেদন করলে শুরুতে তাকে একটি এনআইডি নম্বর দেওয়া হতো। পরে তার তথ্য যাচাই করা হতো।ইসির একটি সূত্র বলছে, একাধিক এনআইডি নেওয়ার বেশির ভাগ ঘটনাই ২০১৯ সালের আগে। যে কারণে একজনের আবারও এনআইডি নেওয়ার জালিয়াতি ধরা পড়েনি। তবে ইসির বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে ধরা পড়েছে, এক ব্যক্তির আঙুলের ছাপ অন্য ব্যক্তির দেওয়ার, ডানের বদলে বাম ও বামের বদলে ডান হাতের আঙুলের ছাপ দেওয়ার, এমনকি হাতের বদলে পায়ের আঙুলের ছাপ দেওয়ার কারসাজিও হয়েছে। এসব হয়েছে মিল এড়ানোর জন্য। আর এতে সহায়তা করেছেন সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কার্যালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী। অবশ্য ইসি এ দায় নিজেদের কর্মকর্তাদের নয়, ডেটা অ্যান্ট্রি অপারেটরদের ওপর চাপাতে চায়।
সূত্র জানায়, ভোটার হতে আসা নাগরিকের আঙুলের ছাপ ৬০ শতাংশ বা তার বেশি না হলে তা সার্ভারে আপলোড না করার নির্দেশনা রয়েছে ইসির। তা সত্ত্বেও তাড়াহুড়ো বা অনৈতিক সুযোগ নিয়ে অনেকে অপূর্ণাঙ্গ ছাপ আপলোড করেছেন। ফলে এক ব্যক্তির একাধিক এনআইডি নেওয়ার সুযোগ থেকে যাচ্ছে। এ ছাড়া একজনের তথ্য আরেকজনের সঙ্গে বদল করার অভিযোগও রয়েছে।ইসির সচিব শফিউল আজিম বলেন, একাধিক এনআইডি বন্ধ করতে এবং এক্ষেত্রে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জালিয়াতি-দুর্নীতি ঠেকাতে মাঠপর্যায়ে আঙুলের ছাপ ও আইরিশের প্রতিচ্ছবি নেওয়ার স্থান সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যবস্থায় ঘাটতি থাকার কারণে এমন হওয়ায় এগুলো ধীরে ধীরে উন্নত করার চেষ্টা চলছে।
একাধিক এনআইডি হয়ে থাকলে করণীয় সম্পর্কে ইসির কর্মকর্তারা বলেন, একাধিক এনআইডি হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নিজ উদ্যোগে স্থানীয় থানা বা উপজেলা নির্বাচন কার্যালয়ে আবেদন করতে হয়। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট নাগরিকের প্রথম এনআইডি বহাল রেখে পরেরটি বাতিল করছে কমিশন।জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, এক ব্যক্তির দুটি এনআইডি কার্ড থাকতে পারে না। এটি অবশ্যই নির্বাচন কমিশনকে সমাধান করতে হবে। এটি শুধু যাচাই-বাছাই করা নয়। যাদের একাধিক এনআইডি আছে, শুনানি করে অথবা তাদের কাছে বার্তা দিয়ে এটি সংশোধন করতে হবে। এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।